রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ০১:৩৩ অপরাহ্ন | মতামত

ড. মাহরুফ চৌধুরী :
একটি আধুনিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব তার প্রতিটি নাগরিকের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নাগরিকের নিরাপত্তা কেবল রাষ্ট্রীয় দয়ার বিষয় নয়, এটি তার সাংবিধানিক অধিকার। রাষ্ট্র তখনই প্রকৃত অর্থে ন্যায্যতা ও নৈতিকতার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে, যখন সে এমন একটি পরিবেশ গড়ে তোলে, যেখানে নাগরিকরা নিরাপদে, স্বাধীনভাবে এবং সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করতে পারে এবং জীবনের শেষ পরিণতিও হয় স্বাভাবিক ও মর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা অত্যন্ত বেদনাদায়ক; আজকের বাংলাদেশে এই মৌলিক অধিকারটি নিশ্চিন্ত নয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিখোঁজ হওয়া, বন্দুকযুদ্ধের নামে ‘অপমৃত্যু’, গণপিটুনী বা গণদোলায়, ধর্ষণ কিংবা সন্ত্রাসের শিকার হয়ে খুন- এসব ঘটনায় নাগরিকের স্বাভাবিক মৃত্যু যেন এক বিলাসিতা হয়ে উঠেছে। তাই ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই’ এই আহ্বান এখন আর কেবল মানবিক আর্তি নয়, বরং এটি এক গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক দাবি হয়ে উঠেছে। এই দাবি রাষ্ট্রব্যবস্থার ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনগণের মৌলিক প্রতিক্রিয়া এবং ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রাথমিক শর্ত।
যখন একটি রাষ্ট্র তার জনগণের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কেবল নামমাত্র থাকে তাকে আর কার্যকর, ন্যায্য বা নৈতিক রাষ্ট্র বলা চলে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, রাষ্ট্রের বৈধতা (লেজিটিমেসি) নির্ভর করে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানে তার সক্ষমতার উপর। জন লকের 'সামাজিক চুক্তি' তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ রাষ্ট্রকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তার মূল শর্তই ছিল ব্যক্তির নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু বাংলাদেশে সেই চুক্তির শর্ত বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিশেষত 'ক্রসফায়ার' যা একরকম রাষ্ট্রীয় হত্যার পর্যায়ে পড়ে তা আমাদের রাষ্ট্রের একটি ঘৃণ্য সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। এটি শুধু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার বিপর্যয়ের প্রতীক। এছাড়াও প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তা অনিবার্য কোনো দুর্ভাগ্য নয়; বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাবের নিষ্ঠুর পরিণতি। অবৈধ রুট পারমিট, লাইসেন্সবিহীন চালক, ট্রাফিক আইনের প্রয়োগে শৈথিল্য সব মিলিয়ে এটি এক রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন।
যখন একটি সমাজের মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে, একে অপরের রক্তে হাত রাঙায়, তখন সেই সমাজ আর মানবিক থাকে না তখন তা এক ধরনের আধুনিক বর্বরতায় পরিণত হয়। ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি তাঁর সভ্যতার বিশ্লেষণে বলেছিলেন, কোনো সভ্যতা বাইরে থেকে নয়, ভেঙে পড়ে ভেতর থেকে যেখানে সহানুভূতি বিলুপ্ত হয়, ন্যায় বিচারের জায়গা দখল করে হিংসা ও প্রতিহিংসা। আজকের সমাজে আমরা যেন সেই ভেতর থেকে ক্ষয়িষ্ণু মানবিকতাকেই প্রত্যক্ষ করছি। রাষ্ট্রের অব্যবস্থা যেমন মানুষের জীবন হরণ করছে, তেমনি সমাজের বিদ্বেষ, ধর্মীয় উগ্রতা, লিঙ্গবৈষম্য, সম্পদের লোভ, জমির বিরোধ বা রাজনৈতিক শত্রুতা এইসবই নাগরিকের স্বাভাবিক মৃত্যুর পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই সহিংস প্রবণতা শুধু বহির্মুখ নয়; এর প্রতিফলন দেখা যায় আত্মঘাতী প্রবণতায়ও। আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান ঘটনাগুলোকে যদি আমরা কেবল মানসিক দুর্বলতা বলে খারিজ করি, তবে সেটি হবে চূড়ান্ত অবিচার। বরং আত্মহত্যা অনেক সময় সমাজের নিষ্ঠুরতা, রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা ও পারস্পরিক সহানুভূতির চরম সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ। যখন রাষ্ট্র তার নাগরিককে সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তাসম্পন্ন জীবনযাপনের পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন অনেকেই সামাজিক প্রতিহিংসার বলি হয় অথবা অবসাদগ্রস্ত হয়ে নিজেকেই নিজের শত্রুতে পরিণত করে। এই মৃত্যুগুলো অস্বাভাবিক, কারণ এগুলো প্রতিরোধযোগ্য ছিল যদি সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করত।
বাংলাদেশের সমাজে ক্রমবর্ধমানভাবে একটি ভয়াবহ প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে যে যখন তখন যে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলছে। ফলে হতাশাগ্রস্ত জনগণ নিজেরাই বিচারক ও শাস্তিদাতা হয়ে উঠছে। কেউ চোর সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হচ্ছে, কেউ আবার ‘ধর্ষকের বিচার রাস্তায়’ স্লোগানের ভেতরে রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে ভিন্নধারার বিচার দাবি করছে। প্রশাসনের উপস্থিতিতেই কখনও কখনও অপরাধীকে ছিনিয়ে নিয়ে গণদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে। এসব ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন উন্মত্ততা নয়, বরং আইন ও শৃঙ্খলার অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট লক্ষণ।
রাষ্ট্রতত্ত্বে ‘আইনের শাসন’ বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং প্রতিটি অপরাধের জন্য শাস্তি বিচার রাষ্ট্রীয় বিদ্যমান বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই সম্পন্ন হবে। কিন্তু যখন রাষ্ট্র এই মৌলিক নীতিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখনই আইনহীনতা ও প্রতিশোধপরায়ণতার এক অন্ধ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা সমাজকে ধীরে ধীরে অরাজকতার দিকে ঠেলে দেয়। এই অরাজকতা কেবল সমাজের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে ব্যাহত করে না; এটি মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর পথেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিচারহীনতার বিরুদ্ধে জনরোষ এবং বিচারবহির্ভূত প্রতিশোধ- এই দুই চরম প্রবণতার ফলে সমাজে ন্যায্যতা, মানবিকতা ও স্বাভাবিকতার ধারণা ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এই সংকটময় ও অমানবিক বাস্তবতা থেকে উত্তরণে রাষ্ট্রের সামনে কিছু অপরিহার্য করণীয় রয়েছে, যা অবিলম্বে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রথমত, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবে বিদ্যমান আইনগুলোর প্রয়োগে। প্রতিটি অপরাধ যেন নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, যথাসময়ে এবং যথোপযুক্তভাবে বিচারাধীন হয় এবং আইনী প্রক্রিয়া দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হয়- এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্ব। বলা হয়ে থাকে, ‘বিচার বিলম্বিত হলে ন্যায়বিচারও অপ্রাপ্ত থেকে যায়’ (জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড)। এই বহুল ব্যবহৃত আপ্ত বাক্যটি আজ আমাদের বাস্তবতার নির্মম প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটি সমাজে সহিংসতা ও প্রতিহিংসার রূপ নেয়, যা রাষ্ট্রকে নৈতিকভাবে অকার্যকর করে তোলে। তাই অপরাধী যেই হোক তার রাজনৈতিক পরিচয়, সামাজিক প্রভাব বা পেশাগত অবস্থান যেমনই হোক তাকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো রাষ্ট্রীয় সহিংসতার সংস্কৃতিকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ ও নৈতিকভাবে ঘৃণিত হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর জবাবদিহির কাঠামোর আওতায় আনতে হবে, যেন তাদের কোনও অপারেশন বা ‘ক্রসফায়ার’ নামের বিচারবর্হিভূত হত্যা নির্ভরতা তৈরি করতে না পারে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়হীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য চরম বিপদসংকেত। এই অপসংস্কৃতির স্থায়ী অবসান ঘটানো রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অনিবার্য। এর মাধ্যমেই কেবল রাষ্ট্র তার জনগণকে একটি নিরাপদ, মর্যাদাসম্পন্ন ও স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে পারে।
তৃতীয়ত, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ রাষ্ট্রের এক অগ্রাধিকারযোগ্য দায়িত্ব হয়ে উঠেছে, বিশেষত এমন এক প্রেক্ষাপটে যেখানে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল, অদক্ষ চালক, দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবহন নীতিমালা ও দুর্বল আইন প্রয়োগের ফলে বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এই পরিস্থিতির উত্তরণে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, দরকার নিরাপদ সড়কের জন্য একটি সমন্বিত রাষ্ট্রীয় কৌশল। এর অংশ হিসেবে চালকদের জন্য যথাযথ ও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ, ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, রুট পারমিট ও ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানকে দুর্নীতিমুক্ত, এবং বিচার বিভাগের কার্যকর হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। সড়কে মৃত্যু যেন আর দৈব ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। প্রতিটি মৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় এনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। প্রতিটি অপমৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
চতুর্থত, সমাজে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা প্রতিরোধে মানবিক বোধ ও নাগরিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা এখন সময়ের দাবি। ব্যক্তিগত আক্রোশ, ধর্মীয় উগ্রতা, রাজনৈতিক হিংসা কিংবা সামাজিক বৈষম্য থেকে উদ্ভূত সহিংসতাগুলো কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতিই ডেকে আনে না, বরং সামগ্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ভেঙে দেয়। রাষ্ট্রকে তাই এমন সকল সহিংসতা রোধে নিরপেক্ষ, কার্যকর ও দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় পক্ষপাত, ধর্মীয় তোষণনীতি কিংবা গোষ্ঠীগত বিবেচনা না করে সকল নাগরিকের নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এই সহিংসতা-প্রতিরোধ শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয়, এটি একটি বৃহত্তর নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বও বটে।
পঞ্চমত, নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিশ্চিত করা এখন আর অতিরিক্ত সুবিধা নয়, এটি রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের একটি অংশ। আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা আমাদের সমাজে এক নীরব মহামারির রূপ নিয়েছে, যা মূলত পারিবারিক ভাঙন, সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং পারস্পরিক সহানুভূতির অভাব থেকে উদ্ভূত। এই সংকট থেকে উত্তরণে মানসিক স্বাস্থ্যকে জনস্বাস্থ্য নীতির কেন্দ্রে রাখতে হবে। প্রতিটি নাগরিক যেন সহজেই গোপনীয়তা ও সম্মানের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ ও সেবা গ্রহণ করতে পারে এমন এক সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রকে বিনিয়োগ ও সদিচ্ছা উভয়ই দেখাতে হবে। মানসিক যন্ত্রণা ও বিষণ্ণতা একা কারো ব্যর্থতা নয়; এটি একটি বৃহত্তর সমাজব্যবস্থার অসাম্য ও অবহেলারই বহিঃপ্রকাশ।
ষষ্ঠত, মানবিক নাগরিক গঠনে শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেবল পরীক্ষানির্ভরতা বা ডিগ্রিকেন্দ্রিকতা থেকে সরিয়ে একটি মূল্যবোধভিত্তিক মানবিক কাঠামোয় রূপান্তর করতে হবে। নৈতিকতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সহনশীলতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ যেন শিক্ষার মূল স্তম্ভ হয়। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শেখাতে হবে। তাদেরকে শিক্ষা দিতে হবে যে, মানুষ মানুষের জন্য, জীবনের প্রতি ভালোবাসাই মানবিকতার ভিত্তি, এবং মতভেদ থাকা সত্ত্বেও অন্যের সাথে সহাবস্থান মানুষের নৈতিক দায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শিক্ষা যদি আমাদের মনুষ্যত্ব না জাগায়, তবে তা শিক্ষা নয়, বোঝা’। শিক্ষা তাই কেবল তথ্য প্রদান নয়, মানবিকতা সৃষ্টি করার এক মহৎ হাতিয়ার, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজকে রক্ষা করতে পারে হিংসা, অবিচার ও অপমৃত্যুর অনৈতিক সংস্কৃতি থেকে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই’ এই আহ্বান কেবল একটি মানবিক আর্তি নয়, এটি নাগরিকের ন্যায্য অধিকার ও রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্বের ঘোষণা। রাষ্ট্র যদি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে তার অস্তিত্ব রাজনৈতিকভাবে বৈধ থাকে না। রাষ্ট্র হয়ে পড়ে নিছক এক দমনযন্ত্র, শাসনের খোলস। উন্নয়ন, অবকাঠামো, প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান কিংবা জীবনের জৌলুষ এসব বাহ্যিক সাফল্য তখনই অর্থবহ হয়, যখন প্রতিটি নাগরিক নিশ্চিত থাকে যে সে একটি নিরাপদ ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবন কাটাবে এবং একদিন সম্মানজনকভাবে স্বাভাবিক পথে মৃত্যুবরণ করবে।
রাষ্ট্রের সাফল্যের মাপকাঠি কোনো পরিসংখ্যানের সংখ্যা নয়, বরং তা নির্ধারিত হয় কতজন নাগরিক প্রতিকূলতা ছাড়াই বেঁচে থাকে, কতজনের জীবনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়, আর কতজন শান্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারে। তাই রাষ্ট্রকে তার নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে মানবিকতা, ন্যায়বোধ এবং প্রতিটি নাগরিকের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তাকে। একমাত্র একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও নিরাপদ রাষ্ট্রই নিশ্চিত করতে পারে এমন একটি সমাজ, যেখানে মানুষ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার ভোগ করে। আমরা সেই সোনালী দিনের আশায় দিন গুনছি যে দিন বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক ভয় বা হতাশায় নয়, আশায় বুক বেঁধে উদ্বিগ্নহীন ও স্বস্তিতে সারাটি জীবন কাটাবে এবং জীবনের স্বাভাবিক পরিণতিতে মৃত্যু বরণ করবে।
* লিখেছেন: ড. মাহরুফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।